দেশ বরেণ্য শিল্পপতি, ক্রীড়া সংগঠক, অ্যাটকো সভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক পাবনার কৃতিসন্তান অঞ্জন চৌধুরী পিন্টুর আজ ৬৯তম জন্মদিন
।। এবিএম ফজলুর রহমান।।
আজ ১৭ জুলাই দেশ বরেণ্য শিল্পপতি, ক্রীড়া সংগঠক, অ্যাটকো সভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক পাবনার কৃতিসন্তান অঞ্জন চৌধুরী পিন্টুর ৬৯তম জন্মদিন। জন্মদিনের আগে সুদুর সুইজারল্যান্ড থেকে বার্তা সংস্থা পিপ‘র প্রধান সম্পাদক ও পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এবিএম ফজলুর রহমানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার দেন।
এ সময় তিনি বলেন, বাবা ব্যবসা শুরু করেন ১৯৫৮ সালে। দাদার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। তখন তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস। এরপর তা স্কয়ার ফার্মা লিমিটেড হয়। গত শতকের আশির দশকে আমাদের ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। শুধু ওষুধ নয়, তখন স্কয়ার থেকে নানামুখী ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাবা আমাকে দেশে ফিরে আসার জন্য বলেন। কারণ, বাবাকে ব্যবসার অনেক দিকে নজর দিতে হয়। তত দিনে আমিও পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছি।
ব্যবসা জীবনের শুরুতেই আমাকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। ওষুধ নিয়ে স্কয়ার তখন সারা দেশে পরিচিত নাম। কিন্তু মেরিল নামটি নতুন। একটি মাত্র পণ্য (জুঁই নারিকেল তেল) নিয়ে ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে স্কয়ার টয়লেট্রিজ। দেশে ফেরার পর বাবা (প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী, চেয়ারম্যান, স্কয়ার গ্রæপ) আমাকে এর দায়িত্ব¡ দেন।
গোড়াতেই আমার কাজ হলো, মেরিল নামটি যত দ্রæত সম্ভব সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলা। ওই সময় মাসের ২৫ দিনই ঢাকার বাইরে থেকেছি। দেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে যাইনি। সেখানে বিভিন্ন মার্কেটে আর দোকানগুলোতে যেতাম। এখন একজন বিক্রয় প্রতিনিধি যেভাবে সবার কাছে যান, তখন আমিও তেমনিভাবে গিয়েছি। বারবার কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, ‘আপনারা কারা? আপনাদের প্রতিষ্ঠানের নাম তো শুনিনি। কী দেবেন? বাকি কত দেবেন?’
আমি সবাইকে বলেছি, আমাদের বাকির কোনো ব্যাপার নেই। শুনে কেউ কেউ বলেছেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। আপনি যান।’ আমি কিন্তু চলে আসিনি। বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিছুক্ষণ পর কেউ আবার দোকানে ডেকে নিয়ে বসতে দিয়েছেন, চা দিয়েছেন, কথা বলেছেন। এটা আমার জন্য একটা শিক্ষা। তা হলো, ধৈর্য থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।‘মেরিল’ নামটা ক্রমেই পরিচিত হতে লাগল। আমাদের পণ্য বাড়ছে। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। সেখান থেকে হলো স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড।
এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতেই একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়ে। খোলা বাজারে প্রচুর ভেজাল মসলা পাওয়া যেত। আমাদের বাড়ী ছিল মফস্বল শহরে। এর একটা বাড়তি সুবিধা হলো, সেখানে খাঁটি জিনিসটা আমাদের হাতের নাগালে। সেই ভাবনা থেকে মনে হলো, আমরা তো ভালো মানের মসলা বাজারে দিতে পারি। এভাবে পাবনায় স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গেই স্কয়ার কনজুমার প্রডাক্টস লিমিটেড শুরু করি। মানুষের চাহিদার কথা ভেবে পরে স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজ শুরু করি।
তবে ১৯৭১ সালে দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হল তখন একটা সময়ে এসব দিকে আমার মোটেও আগ্রহ ছিল না। ১৯৭১ সালে আমি ১৭ বছরের তরুন। ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে পড়তাম। তখন ফিরে যাই পাবনায়, আমাদের বাড়ীতে। কিন্তু সেই সময়ে হাত-পা গুটিয়ে কি বসে থাকা যায় ?। আমিও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। বন্ধুরা মিলে চলে যাই ভারতে। যোগ দেই মুজিব বাহিনীতে। দেরাদুনের চকরাতা আর্মি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো প্রশিক্ষণ নিই। এক সময় দেশ স্বাধীন হলো। এখন আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।
ওই সময় দেশের তরুণদের একটা অংশ চলে যায় রাশিয়ায়। বাবা আমাকে নিয়ে তেমনি কিছু ভেবেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় ট্রাই-স্টেট কলেজে আমার ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সাত দিনের মধ্যেই চলে যাই। এই কলেজটি এখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। পড়াশোনা করেছি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। এরপর আমাদের ব্যবসা-সংক্রান্ত কিছু দিক ওখানে দেখাশোনা করেছি। রিয়েল এস্টেট আর গার্মেন্টস ব্যবসা। কিন্তু তখন মন পড়ে থাকত দেশে। প্রায় প্রতিবছরই বড়দিনের ছুটিতে দেশে আসতাম। পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতাম।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড থেকে নানা দিকে ব্যবসার প্রসার হতে থাকে। একটি পণ্য নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের শুরু, তা ডালপালা ছড়ায়। নিজেদের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গিয়েই নতুন অভিজ্ঞতা হয় আমার। দেখি নির্মাতাদের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো কাজ পাওয়া যায় না। পণ্য বিপণনের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের একটা যোগসূত্র তো আছেই। এখানে এর ব্যাঘাত ঘটছিল। ফলে ক্ষোভ থেকেই এক সময় নিজেই বিজ্ঞাপনী সংস্থা গড়ে তুলি, নাম মিডিয়াকম। তখন আবার দেখি চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সেই ভাবনা থেকে জন্ম নেয় মাছরাঙা। এখান থেকে বিজ্ঞাপনচিত্র আর টিভি নাটক তৈরি করতে শুরু করি। চলচ্চিত্রের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হই। এ পর্যন্ত লালসালু, শঙ্খনদ, আয়না, লালন, মনপুরা, হাওয়া ছবিগুলো প্রযোজনা করেছি। মনপুরা ও বিশ্ব সুন্দরির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। এভাবে গণ্যমাধ্যমেও কাজের শুরু আমাদের। আমি পাবনা প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি বর্তমানে জীবন সদস্য। এ ছাড়া দেড় ‘শ বছরের প্রাচীন অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী এবং বনমালি শিল্পকলা কেন্দ্রের সভাপতি।
বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুমতি পায় একুশে টিভি। এর লাইসেন্স পান এ এস মাহমুদ। তিনি ছিলেন বাবার বন্ধু। তাঁর আমন্ত্রণে আমরা এই টিভি চ্যানেলের পরিচালক হলাম। পরে নানা কারণে আমরা এটি ছেড়ে দিই। পরে আমাকে এনটিভির শেয়ার দেওয়া হয়। মাছরাঙার নামে টিভির লাইসেন্স পাওয়ার পর আমি ওই শেয়ার বিক্রি করে দিই। মাছরাঙা টিভিকে ঢেলে সাজাই। অনুষ্ঠানগুলো এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করি, যাতে তা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দেখতে পারে। এখানে আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, ইতিবাচক বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। মাছরাঙা টেলিভিশন এবং রেডিও দিনরাত-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কাজ করছি এখন।
ছোটবেলা থেকে আমি খেলাধুলা ভালোবাসতাম। ফুটবল, ক্রিকেট আর শীতের সময়ে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ১৯৯১ সালে দেশে ফেরার পর আমাকে পাবনার জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন সরাসরি খেলার উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। পরিচিতজনদের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আবাহনীর সঙ্গে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহসভাপতি, আবাহনী ক্রীড়া চক্রের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আমাকে যুক্ত করা হয়। পরে আবাহনী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হয়। আর আমি হই এর পরিচালক। এ ছাড়া বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এখন কাজ করছি। পাবনা রাইফেল ক্লাবের সঙ্গে আমি অনেক বছর ধরেই জড়িত আছি। আমরা পাবনা এবং জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করছি।
আর কিছু সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছি আমি। অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন কোম্পানি ওনার্স (অ্যাটকো), অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করছি।
বাংলাদেশের তরুণ শিল্পীদের সহযোগিতা করার জন্য ‘সোসাইটি ফর প্রমোশন ফর বাংলাদেশ আর্ট’ প্রতিষ্ঠা হয় ২০০২ সালে। এখন এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেও যুক্ত আছি। এ ছাড়া নারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘মাইডাস’ এর চেয়ারম্যান ছিলাম এখন পরিচালক পদে আছি।
গত শতকের নব্বউয়ের দশকে রাজধানীর পান্থপথে একটা জায়গা কেনেন বাবা। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সেখানে একটা হাসপাতাল করার, স্কয়ার হাসপাতাল। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। এখন আমরা এ দেশেই সবাইকে বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
বাবা ছিলেন আমার শিক্ষক, পথ প্রদর্শক। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বাবা খুব নিয়ম মেনে চলতেন। তাঁর শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, সরলতা; সবকিছুই ছিল অনুকরণীয়। সময়ে কাজ তিনি সময়ে করতেন। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত শ্রমিক অসন্তোষ হয়নি। প্রতিবছর বাবা শ্রমিকসংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতেন। নিয়ম মেনে নয়, এটাই ঐতিহ্য। প্রত্যাশার চেয়ে তিনি বেশি দিয়ে এসেছেন সব সময়। তিনি তাদের সঙ্গে যেভাবে আলোচনা করতেন, মনে হতো যেন নিজের পরিবারের মধ্যে বসে আলোচনা করছেন। বাবার কাছ থেকে এভাবেই শিক্ষা পেয়েছি।
সবার আস্থা আমাদের শক্তি। এত বছরে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সবার মাঝে যে আস্থা তৈরি হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে যেন তা আরও সুদৃঢ় হয়, সেই চেষ্টা আমার অব্যাহত আছে।
স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু আক্ষেপের সঙ্গে বার্তা সংস্থা পিপ‘কে বলেন, দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘স্কয়ার’ সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের সুনামের সঙ্গে কোন কমপ্রমাইজ করিনা।
চলতি বছরের ১৫ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পাবনায় সফর করেন। সেই সফর উপলক্ষে গঠিত নাগরিক সংবর্ধণা অনুষ্ঠানের আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার তত্ত্বাবধানে পাবনার সকল কর্মসুচি সফলভাবে সম্পন্ন হয়।
ব্যাক্তিগত জীবনে অঞ্জন চৌধুরী স্ত্রী মনিরা এম চৌধুরী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে। তার মা অনিতা চৌধুরী গত বছরের ১৩ নভেম্বর মারা গেছেন। বড় ভাই স্যামুয়েল এস চৌধুরী স্বপন চৌধুরী, (স্কয়ার গ্রæপের চেয়ারম্যান) বোন রত্না পাত্র (স্কয়ার গ্রæপের ভাইস চেয়ারম্যান) এবং মেঝ ভাই তপন চৌধুরী (স্কয়ার গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক)। লেখক : এবিএম ফজলুর রহমান, সভাপতি পাবনা প্রেসক্লাব ও স্টাফ রির্পোটার, দৈনিক সমকাল ও এনটিভি।