==== মুনমুন আক্তার ====
শত্রু কখনো বাইরের লোক হয় না বরং খুব কাছের আপনজনই হয়। বিশ্বাসঘাতকতা অচেনা মানুষ করে না, উপকারভোগী চেনা কাছের মানুষই করে। ইতিহাস সাক্ষ্যি আছে যে, আজ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে যারা নিজেদের জিবন দিয়েছেন তারা সকলেই খুব কাছের চেনা মানুষের দ্বারাই প্রতারিত হয়েছেন এবং কাছের মানুষগুলোই তাদের মৃত্যুর মূল কারণ হয়েছে । কখনো নিজের হাতে মেরেছে আবার কখনো ছলনা করে পরিকল্পিতভাবে খুন করিয়েছে কিন্তু সর্বমূলে সেই চেনা মানুষই ।
যেমন:
একটা প্রবাদ আছে যে, “ঘরের শত্রু বিভিষণ” এটা বলার মূল কারণ হলো বিভিষণ ছিলো রাবণের ছোট ভাই। লংকেরস্বর রাবণ যখন সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে আসে তখন রাম এবং লক্ষণ সীতাকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে লংকার অভিমুখে যাত্রা শুরু করে কিন্তু লংকেরস্বর রাবণ তার রাজ্যকে খুবই ভালোবাসতো এবং তার রাজ্যের সুরক্ষার জন্য সকল ব্যবস্থায় করেছিলো যাতে শত্রু অর্থাৎ রাম এবং লক্ষণ প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ ও পুত্র বীরবাহুকে হত্যার পরে যখন রাবণ একেবারেই ভেঙে পরে তখন তার বড় পুত্র মেঘনাদ সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। ঠিক তখনই তার চাচা বিভিষণ বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুকে ভেতরে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে এবং রাবণকে পরাজিত করে। বিভিষণ তার আপন বড় ভাইয়ের সাথে বেঈমানি করে তাই তখন থেকে এই প্রবাদ বাক্যটি বলা হয়ে থাকে যে,
“ঘরের শত্রু বিভিষণ” । কবে কখন কিভাবে বিভিষণ তার ভাইয়ের শত্রুতে পরিণত হয়েছে অন্ধ ভালোবাসার কারণে রাবণ তা বুঝতেই পারেনি।
আবার ঠিক এমনি ভাবে ১৭৫৭ সালে আপন মানুষের দ্বারাই পলাশির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংরেজদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাকে তার আপন বড় খালা ঘোষেটি বেগম, সেনাপতি মির্জাফরসহ বেশকয়েকজন সভাষদগণ মিলে ইংরেজদের সাথে আতাত করে নবাব সিরজাউদ্দৌলাকে পরিকল্পিতভাবে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করে এবং তাকে হত্যা করে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে তারই আপন বড় খালা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং তারই সেনাপতি মির্জাফরের চক্রান্তেই তার মৃত্যু ঘটে।
আবার,
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন’কে যখন ফাঁসি দেয়া হয় তখন একদল লোক এসে তার মৃত দেহের ওপর থুথু নিক্ষেপ করে অথচ তারা ইরাকেরই উপকার ভোগী নারগিক। দুঃখের বিষয় এটাই যে,যারা তার মৃত্যুতে আনন্দ উপভোগ করলো, মৃত্যুর পরে সাদ্দাম হোসেনের দেহকে ধিক্কার দিলো তাদেরকেই একসময় সাদ্দাম হোসেন নিরাপত্তা দিয়ে সুরক্ষা প্রদান করেছিলেন। পক্ষান্তরে সাদ্দাম হোসেনের ১২ জন আমেরিকান দেহরক্ষি ছিলো যারা তার মৃত্যুতে শোকাহত ও কাঁন্নায় ভেঙে পরেছিলো।
আবার,,,,,,
ভারতের প্রেসিডেন্ট “ইন্দিরাগান্ধী” তারও পরিণতি কঠিন দূঃর্বিসহ হয়েছিলো কারণ তাকে বাইরের কোন শত্রু নয় বরং যারা তার দেহ রক্ষি হিসাবে নিযুক্ত ছিলো তারাই গুলি করে হত্যা করেছিলো। এখানে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, তারা ইন্দিরাগান্ধীর সুরক্ষা প্রদানের জন্য ছিলো না বরং তারা তাকে হত্যা করার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো ।
আমরা যদি ভালো ভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো যে, আমাদের বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পরিবারে হত্যাযোজ্ঞ সংগঠিত হয়েছিলো তা বহিরাগত কোন শত্রুর দ্বারা হয়নি বরং খুবই চেনা একজন কাছের বিশ্বস্ত মানুষের দ্বারাই হয়েছে । যা সবার কল্পনাতিত ব্যাপার। দুঃখজনক ও নিন্দনীয় হলেও নির্মন সত্য এই যে, বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃতদেহ নামাতে কবরে নেমেছিলো যে ব্যক্তি, বঙ্গবন্ধুর মাতার মৃত্যুতে যে কাঁন্নায় ভেঙে পরেছিলো, মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়েছিলো। যে শেখ কামালের বিয়ের সময় উকিল বাপ হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট যে লোকটি নিজের বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য রান্না করে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়েছিলো, সেই ব্যক্তিই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের জন্য কাল হয়েছিলো। সেই ব্যক্তিই পরিকল্পিত ভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে স্ব-মূলে ধ্বংস করার সকল আয়োজন করেছিলো। সে আর কেউ নয়, সে হলো স্বাধীন বাংলার চিহ্নিত ও ধিকৃত খন্দকার মোস্তাক আহমেদ। যার কু- সড়যন্ত্রের কারণে বিপথগামী ফারুক, রশিদদের মতো কিছু কুলাঙ্গার অফিসার বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার বর্গকে র্নিমম ও নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই সব হায়নাদের হাত থেকে ৮ বছরের ছোট শিশু শেখ রাসেলও রক্ষা পায়নি । স্বাধীন বাংলার চিহ্নিত ও ধিকৃত মির্জাফর খন্দকার মোস্তাক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের লাশের উপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়েছিলো। এই নিকৃষ্ট পাপী জাতির সাথে বেঈমানি করে খুব বেশি সময় টিকতে পারেনি। তাকে আস্তাখুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে । এখানেও এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিভিষণরা কাছেই আপন সেজে অবস্থান করে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই বিষয়টিই বার বার প্রমাণিত হয় যে , যুগে যুগে যেসব সামরাজ্যের পতন হয়েছে তার পেছনে মূল ভূমিকায় পালন করেছে ঘরের শত্রু বিভিষণ। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত এই একই চিত্র এখনও বিদ্যমান। বলা যায় আগামীতে আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। অতএব, সাধু সাবধান।