ঢাকা অফিস।।
ফের লকডাউনে দেশ। নতুন করে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীকাল সোমবার (৫ এপ্রিল) থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন লকডাউন পরিকল্পনা নিয়ে বলেন, লকডাউন চলাকালে শুধু জরুরিসেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। ট্রেন, লঞ্চ, বিমানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকবে। তবে গার্মেন্টসসহ শিল্প কলকারখানা খোলা থাকবে, যাতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন শিফটে কাজ করতে পারে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লকডাউনে ব্যাংক সীমিতভাবে খোলা থাকবে। শেয়ার বাজার খোলা থাকবে বলে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে নিশ্চিত করা হয়েছে। তারও আগে পর্যটনকেন্দ্র, শপিংমল-দোকানপাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।
এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সোমবার থেকে এক সপ্তাহের ‘লকডাউন’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই লকডাউন গতবছরের সাধারণ ছুটির মতো হবে, না-কি মিরপুরের টোলারবাগ বা অন্য এলাকায় যেভাবে সব কিছু বন্ধ ছিল এবং চলাচল নিয়ন্ত্রিত ছিল- তেমন হবে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। লকডাউন প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে মানুষ মনে করে ছুটি হয়েছে, ঘুরতে চলে যায়। এ কারণে এবার লকডাউন দেয়া হয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২০২০ সালের ২৩ মার্চ প্রথমবার সাধারণ ছুটির ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। ওই বছর শুরুতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি দেয়ার পর মেয়াদ বাড়ানো হয় কয়েক দফা। ওই সময় সব অফিস আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছুটির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিতি পায়। কিছু পরীক্ষা নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় খোলেনি।
এর আগে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিতের পর দেশে গত বছরের মার্চের শুরুতে রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ এলাকা প্রথম ‘লকডাউন’ করা হয়েছিল। ১৯ মার্চ মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা ‘লকডাউন’ করা হয়। সাধারণ ছুটির পরও এলাকাভিত্তিক লকডাউনের অংশ হিসেবে দুই থেকে তিন সপ্তাহ অবরুদ্ধ রাখা হয়েছিল রাজাবাজার ও ওয়ারীসহ রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
লকডাউন প্রসঙ্গে গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় জাতীয় কমিটির পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লকডাউনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আংশিক লকডাউনের পাশাপাশি পুরো লকডাউনের সুপারিশও ছিল। সংক্রমণ পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে গেলে লকডাউন দেয়ার চিন্তা সরকারের আগেই ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে ১৮ দফা যে প্রস্তাব করা হয়েছিল তা অনেক ভেবেচিন্তে, অনেকের পরামর্শ নিয়ে করা হয়েছে। সরকার শুরুতে সব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেনি। এখন আস্তে আস্তে কঠোর হচ্ছে।
জানতে চাইলে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, অতিরিক্ত ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় লকডাউনের ব্যাপারে কমিটি সুপারিশ করেছিলেন। তবে তা দেশজুড়ে করার প্রস্তাব ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৮ দফা প্রস্তাবের একটা ছিল কিছু এলাকায় আংশিক লকডাউন। আমরা বলেছিলাম- হয় আংশিক, নয় মোডিফাইড লকডাউন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যদি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাহলে ওই ব্যক্তির পুরো বাড়ি বা ফ্ল্যাটকে দুই সপ্তাহের জন্য লকডাউন করে ফেলা। এই সময় বাইরের সঙ্গে মেলামেশা পুরো বন্ধ রাখতে হবে। তাদের দৈনিক প্রয়োজন বাইরে থেকে মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটাকে তারা মোডিফায়েড লকডাউন বলছেন।
জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, লকডাউনের যে ঘোষণা এসেছে, সেটি ‘টার্গেটেড’ না ‘বø্যাাংকেট’ তা এখনও স্পষ্ট নয়। যেখানে অনেক মানুষের ভিড় হয়, সেখানে সংক্রমণ বেশি ছড়ায়। সেখানে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় নিয়ে আসা হলো টার্গেটেড পদ্ধতি। আর সারা দেশে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ঘরে রাখা হলো বø্যাংকেট অ্যাপ্রোচ। শেষ উপায় হিসেবে সরকার এ পন্থায় যেতে পারে। এই চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ বলেন, করোনা ঠেকাতে মানুষকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, সেখানে বø্যাংকেট দিতে হবে। কিন্তু এটাই একমাত্র সমাধান না। কারণ এটা এক সময় লকডাউন তুলে নিতে হবে। এ কারণে টার্গেটেড পন্থা অনুসরণ করে তা অনেকদিন ধরে চালাতে হবে। তবে এ ধরনের লকডাউন দিলে নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। না হলে তারা খাদ্যের জন্য বাইরে বেরিয়ে যাবে। তখন আমরা কেউ নিরাপদ থাকতে পারব না। এটা সফল হবে না, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
দেশে মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণের সংখ্যাও প্রতিদিন ভয়াবহ হারে বাড়ছে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯ হাজার ২১৩ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজর ৬৮৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৭ জন। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণের হার শতকরা ২৩ পয়েন্ট ১৫ শতাংশ। অথচ ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগী কমতে শুরু করে; পাশাপাশি কমতে থাকে সংক্রমণের হারও।
চলতি বছরের ১৩ ফেব্রæয়ারি মাত্র ২৯১ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় পরে আবার বাড়তে শুরু করে সংক্রমণ। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণের মাত্রা অনেক বাড়তে থাকে। ২৩ মার্চ তা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২৯ মার্চ থেকে টানা তিন দিন দৈনিক শনাক্ত ৫ হাজারের বেশি থাকে। ১ এপ্রিল ৬ হাজারের ঘর ছাড়ায়।