চাঞ্চল্যকর তপু হত্যা রহস্য উদঘাটনসহ গ্রেফতার ২
স্টাফ রিপোর্টার।।
পাবনার ঈশ্বরদীতে চাঞ্চল্যকর তপু হত্যার রহস্য উদঘাটনসহ জয়নাল আবেদিন জয় (২০) ও ঈশা খালাশি (১৯) নামে ২ জনকে গ্রেফতার করেছে ঈশ্বরদী থানা পুলিশ।
মাদক সেবনকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে রুমে আটকিয়ে ভয়ভীতি দেখাতে গিয়েই উত্তেজিত হয়ে বন্ধু তপু হোসেনকে (১৪) হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে গ্রেফতারকৃত জয়নাল আবেদিন জয় ও ঈশা খালাশি।
গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্যমতে হত্যার সাথে জড়িত মোঃ সোহেল (২২) নামে আরেকজন পলাতক রয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করছে।
সোমবার ২৪ জুন সন্ধ্যায় গ্রেফতারকৃতরা তপু হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মোঃ মাসুদ আলম।
নিহত তপু হোসেন ঈশ্বরদীর মশুড়িয়া পাড়ার মোঃ আবুল কাশেম প্রামানিকের ছেলে। সে ঈশ্বরদী শহরের বকুলের মোড়ের একটি লেদ কারখানায় কাজ করতো।
গ্রেফতারকৃত জয়নাল আবেদিন জয় পাবনার আতাইকুলা থানার দুবলিয়া এলাকার জিয়াউর রহমানের ছেলে। সে ঈশ্বরদী সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র এবং মশুড়িয়া পাড়ার অরণ্য ছাত্রাবাসের ৩০৫ নং রুমে থাকতো। এছাড়াও জয়ের নামে আতাইকুলা থানায় একটি হত্যা মামলা আছে এবং এই হত্যা মামলায় চার মাস আগে জেল থেকে অস্থায়ী জামিনে বের হয়েছে ।
অপর গ্রেফতারকৃত ঈশা খালাশি ঈশ্বরদীর মশুড়িয়া পাড়ার রাজন খালাশির ছেলে। ঈশা নিহত তপুর বন্ধু এবং প্রতিবেশী।
হত্যার সাথে জড়িত পলাতক মোঃ সোহেল রাজশাহীর বাঘার চক রাজাপুর এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে। সেও অরণ্য ছাত্রাবাসে থাকতো এবং ঈশ্বরদীর জৈনক দলিল লেখকের সহকারি হিসেবে কাজ করতো।
এই ঘটনায় নিহত তপু হোসেনের বাবা মোঃ আবুল কাশেম প্রামানিক বাদী হয়ে ঈশ্বরদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
এর আগে নিখোঁজের সাতদিন পর গত শনিবার (২২ জুন) রাত দুইটার দিকে ঈশ্বরদী সরকারী কলেজের পেছনে মশুরিয়াপাড়ার অরণ্য ছাত্রাবাসের তিন তলার ৩০৫ নং কক্ষের ট্র্যাঙ্ক থেকে তপুর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে রাজশাহী ক্রাইমসিন ডিপার্টমেন্টের একটি বিশেষ দল। গত ১৫ জুন দুপুরের দিকে কিশোর তপু হোসেন নিখোঁজ হয়।
স্থানীয় ও তপুর বন্ধুদের সূত্রে জানা যায়, নিহত তপু হোসেন ও ঈশা খালাশি দুইজন বন্ধু। তারা এক সঙ্গেই চলাফেরা করতো। অরণ্য ছাত্রাবাস তাদের এলাকায় হওয়ায় সোহেলের সাথে তাদের পরিচয় হয়। এই সোহেলের মাধ্যমে পরে জয়ের সাথে পরিচয় হয়। তারা সকলেই পার্শ্ববর্তী মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক মোঃ আলি হোসেন হাসুর দোকানে বসে আড্ডা দিত।
অপরদিকে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পূর্ব থেকেই নিহত তপুর বাবা আবুল কাশেমের সঙ্গে মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক ও দোকানদার হাসুর বিরোধ চলে আসছিল। এর সঙ্গে হাসুর দোকানে বসে ছেলের আড্ডা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে হাসুর সঙ্গে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। এক পর্যায় নিখোঁজের ৪ দিন আগে তপুকে কেটে টুকরো টুকরো করার হুমকিও দেয় হাসু ও তার মা রেনু বেগম।
এদিকে দোকানে আড্ডা দেওয়ার সুবাদে মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক হাসুর সঙ্গে অরণ্য ছাত্রাবাসের সোহেলের সুসম্পর্ক তৈরী হয়। অপরদিকে মাদকাসক্ত ও পূর্ব থেকেই হত্যা মামলায় অভিযুক্ত জয় ছাত্রাবাসের ভাড়ার টাকাসহ বেশ কিছু টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এসকল কারনে নিহত তপুর বাবা হাসুকে হত্যার সাথে জড়িত বলে দাবী করেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ভারতীয় ক্রাইম পেট্রোল সিরিজের ক্রাইমসিন দেখে ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই ছাত্রাবাসে থাকা আরেক ছাত্র মনিরুজ্জামানের মোবাইল ফোন চুরি করে জয়। এই ফোন দিয়েই ঘটনার দিন (১৫ জুন) বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তপুকে অরণ্য ছাত্রাবাসের নিজের কক্ষে ডাকে জয়। তপু তখন জয়ের কক্ষে গিয়ে দুজনে মিলে মাদক সেবন করে। এরই মধ্যে সোহেল ও ঈশা খালাশি ওই কক্ষে প্রবেশ করে দরজা আটকিয়ে দেয়।
এরপর তারা তপুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়। তখন তপু চিৎকার করার চেষ্টা করলে সোহেল পেছন থেকে তপুর মুখ চেপে ধরে। আর ঈশা খালাশি ওই কক্ষে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে তপুর বুকে আঘাত করে। পরে জয়ের প্যান্টের বেল্ট দিয়ে তপুর হাত বেঁধে জীবিত অবস্থায় বস্তার মধ্যে ভরে রাখে। এরপর তারা চাদর দিয়ে রক্ত পরিস্কার করে।
হত্যার আলামত নষ্ট করতে তারা চাদরটিকে পরিস্কার করে শুকিয়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে ফেলে। একই সঙ্গে হত্যায় ব্যবহৃত ধারালো ছুরিটি সাবান ও ডিটারজেন দিয়ে ধুয়ে বালু দিয়ে পরিস্কার করে। হাতে গ্লোভস পরে ছুরির হাতল সিরিচ কাগজ দিয়ে ঘষে। এরপর ছুরিটি ঈসা খালাশি বাড়িতে তার নিজ কক্ষে স্কুল ব্যাগের ভিতরে ভরে লুকিয়ে রাখে।
এরপর সোহেল ও ঈশা খালাশিকে ওই কক্ষে রেখে তপুর মোবাইল ফোন নিয়ে জয় বের হয়ে আসে। তখন ঈশা খালাশি নিজের বাড়ি থেকে একটি টিনের ট্র্যাঙ্ক ও পলিথিন নিয়ে এসে নিহত তপুর মরদেহটি ট্রাঙ্কের মধ্যে ভরে রাখে। ঘটনার দিন থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত সোহেল ঐ রুমেই থাকে এবং ঈদের পরেরদিন দিন বাড়ি চলে যায়।
এদিকে জয় সুকৌশলে হত্যাকান্ডের ঘটনাকে অপহরণ বলে চালানোর জন্য অপর ছাত্রের চুরি যাওয়া মোবাইল ফোন থেকে তপুর বাবা আবুল কাশেমের নিকট থেকে মুক্তিপন হিসেবে বিকাশে ৩০ হাজার টাকা দাবী করে। ছেলের বিপদের কথা ভেবে বাবা আবুল কাশেম ওই নম্বরে খরচসহ ৭ হাজার টাকা পাঠায়। এরপরই ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দেয়। আর ফোনটি দাশুড়িয়ার একটি জঙ্গলময় পুকুরে ফেলে দেয়।
থানা সুত্র জানায়, কিশোর তপু নিখোঁজ হলে তার মা মজিরন বেগম বাদী হয়ে গত ১৬ জুন থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ঈদের ছুটির পর শিক্ষার্থীরা অরণ্য ছাত্রাবাসে ফিরে আসে। অরণ্য ছাত্রাবাসের ৩০৪ নং কক্ষের বর্ডার পাশের কক্ষ থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধ ও রক্ত দেখে ছাত্রাবাসের আয়ার মাধ্যমে মালিকদের খবর দেন। তারা বিষয়টি থানায় জানালে পুলিশ ওই ছাত্রাবাসে গিয়ে তালা ভেঙ্গে কক্ষের ট্রাঙ্কের ভিতরে অর্ধগলিত মরদেহ দেখতে পায়। পরে সিআইডি’র সহায়তায় মরদেহ উদ্ধার করে।
নিহত তপুর বাবা মোঃ আবুল কাশেম প্রামানিক জানান, তার ছেলেকে হত্যার পেছনে মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক ও দোকানদার মোঃ আলি হোসেন হাসু ও তার মা জড়িত। থানায় অভিযোগে তাদের আসামী করার কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের আসামী করা হয়নি।
মাতৃছায়া ছাত্রাবাসের মালিক ও দোকানদার মোঃ আলি হোসেন হাসুর বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং তার মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
ঈশ্বরদী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, ছেলের মৃত্যু শোকে নিহত তপুর বাবার মাথার ঠিক নেই। উনি অনেক অভিযোগই নিয়ে আসতে পারেন। হত্যায় যারা জড়িত তাদের দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে। এজন্য অন্যদের আসামী করা হয়নি।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মোঃ মাসুদ আলম জানান, হত্যাকারীরা তপুকে প্রথমে জিম্মি করে পরিবারের নিকট থেকে অর্থ আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু তপু জোরাজুরি করায় তাকে হত্যা করেছে বলে গ্রেফতারকৃতরা আদালতে স্বীকার করেছে। তদন্ত করে হত্যায় তিনজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাই মামলায় হাসু ও তার মাকে আসামী করা হয়নি। পলাতক আসামী সোহেলকে গ্রেফতারের পর যদি নতুন কোন তথ্য পাওয়া যায় তখন হত্যার পেছনে আরও কোন কারণ আছে কিনা তা পরিস্কার হওয়া যাবে। পালাতক আসামিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।