ঢাকা অফিস।।
দেশে করোনা সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৬ জন। এ সময় নতুন করে আরো ৭২১৩ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। গতকাল একদিনে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় কঠোরভাবে লকডাউন পালিত না হলে করোনাভাইরাসের কারণেই দেশে স্বাস্থ্যসেবায় মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। এখনই হাসপাতালে ঠাঁই নেই। তখন করোনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশে লকডাউন বলতে প্রথম থেকে যে চিত্র আমরা দেখেছি এবং সরকারের যে ঘোষণা কোনোটাই বৈজ্ঞানিক নয়। আংশিক লকডাউন বলতে কোনো লকডাউন নেই। লকডাউন মানেই হলো লকডাউন। সরকার ঘোষিত চলমান লকডাউন যেহেতু বৈজ্ঞানিক নয়, তাই জনসাধারণ এটাকে সেভাবে নেয়নি। কারণ, এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, যেভাবে এটা ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করা ছাড়া লকডাউন কর্মসূচি সফল বা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এর আগে শুরু হয় লকডাউন। কিন্তু পরিকল্পনাহীন, অব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণহীনতায় লকডাউন কার্যত ‘তামাশার লকডাউন’ হয়ে গেছে। লকডাউনে সন্ধ্যা ৬টার পর সবকিছু বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হলেও এ সময় দেখা গেছে সর্বত্রই ভিড়। মার্কেট-দোকান সবখানে মানুষের স্রোত। স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে বাধ্য করতে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হলেও মানুষ গাদাগাদি করে বিকল্প যানবাহনে চলাচল করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আংশিক লকডাউন সফল হয় না। এর বৈজ্ঞানিক ভিক্তি নেই। বিধিনিষেধ বা লকডাউন যাই বলা হোক তা আংশিক বাস্তবায়ন করলে সফলতা আসবে না। লকডাউন দিলে পুরো লকডাউন দিতে হবে। বাস্তবতা হলো প্রশাসন কার্যত আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর যখন লকডাউন ঘোষণা করা হলো, ওই সময় পুলিশ যা করণীয় সবই করেছে। দোকানপাট বন্ধে নির্দেশনা ও তদারকি, সড়কে অযথা ঘোরাফেরা বন্ধে নজরদারি, অনাহারির বাসায় খাবার পৌঁছে দেয়া, ওষুধ সরবরাহ, রোগী নেয়া, লাশ দাফনে সহায়তা, মাস্ক বিতরণসহ নানারকম কাজ করেছে। কিন্তু এবার দুই দিন পার হয়ে গেলেও পুলিশকে তেমন কোনো ভ‚মিকা পালন করতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে যাই বলুক শেষ পর্যন্ত পুলিশকেই ‘লকডাউন’ বাস্তবায়নে ভ‚মিকা রাখতে হবে। তবে সেটা আগে থেকে করলে প্রকৃত ফল পাওয়া যাবে। না হলে এরকম শতাধিক দিন ‘লকডাউন’ থাকলেও কোনো কাজে আসবে না। করোনা সংক্রমণ এড়াতে ‘লকডাউন’ ঢিলেঢালা নয়, সম্পূর্ণভাবে পালন করতে হবে।
৪ এপ্রিল লকডাউন ঘোষণায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১১ দফা নির্দেশনা জারি এবং তারও আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের ১৮ দফা নির্দেশনা সবকিছুই যেন ‘অপরিকল্পিত’ লকডাউনের নামান্তর। করোনার কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। এখন লঞ্চ, গণপরিবহন, ট্রেন, অভ্যন্তরীণ বিমান, মার্কেট, দোকান বন্ধ; অথচ একই সময়ে বাংলা একাডেমির ‘বইমেলা’ ও ‘বাংলাদেশ গেইম’ চালু রাখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন করোনায় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলে বইমেলা খোলা রাখা হচ্ছে কার স্বার্থে? বইমেলায় কি করোনা সংক্রমণ বাড়ায় না? বাংলাদেশে এই করোনার সময় খেলাধুলা অব্যাহত রাখার মাজেজা কি? মানুষের জীবনের চেয়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা ও বাংলাদেশ গেইমের মূল্য বেশি? সারাদেশের বিভিন্ন মার্কেটের দোকান মালিক ও শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন বইমেলা খোলা রাখলে মার্কেট খোলা রাখতে অসুবিধা কি? কার স্বার্থ রক্ষায় গার্মেন্টস ও বইমেলা খোলা রাখা হয়েছে?
বিশেষজ্ঞদের কথাই সত্যি হলো। আংশিক লকডাউন সফল হবে না। গতকাল করোনার বিস্তার ঠেকাতে সারাদেশে এক সপ্তাহের জন্য গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭ এপ্রিল থেকে সকাল-সন্ধ্যা গণপরিবহন সেবা চালু থাকবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে গণপরিবহন বন্ধ করা হলো কেন আর দু’দিনের মাথায় চালু করার ঘোষণা দেয়া হলো কেন? সবই কি গণবিচ্ছিন্নতার কারণে অপরিকল্পিত চিন্তা-চেতনার ফসল?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ খুবই শক্তিশালী। নতুন ভাইরাস খুবই ভয়ঙ্কর। লকডাউন দিয়ে মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ ঠেকানো উচিত। আধা-লকডাউন ও ঢিলেঢালা লকডাউনে কোনো কাজ হবে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে। এক সপ্তাহের লকডাউন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। করোনা ভাইরাসের সুপ্তিকাল ১৪ দিন। করোনা ভাইরাস শরীরে ১৪ দিন পর্যন্ত ঘাপটি মেরে থাকতে সমর্থ। শরীরে প্রবেশের ১৪তম দিনেও ভাইরাসটি রোগ তৈরিতে সক্ষম। এজন্য বৈজ্ঞানিক বিবেচনা থেকে লকডাউন দিলে কমপক্ষে ২ সপ্তাহ হওয়া উচিত। আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যে লকডাউন চলছে তা ‘টার্গেটেড’ না ‘বø্যাাংকেট’ তা এখনও স্পষ্ট নয়। যেখানে অনেক মানুষের ভিড় হয়, সেখানে সংক্রমণ বেশি ছড়ায়। সেখানে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এবং কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় নিয়ে আসা হলো টার্গেটেড পদ্ধতি। আর সারাদেশে যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ঘরে রাখা হলো বø্যাংকেট অ্যাপ্রোচ। করোনা ঠেকাতে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে যদি না পারি, সেখানে বø্যাংকেট দিতে হবে। এটা এক সময় লকডাউন তুলে নিতে হবে। এ কারণে টার্গেটেড পন্থা অনুসরণ করে তা অনেকদিন ধরে চালাতে হবে। এ ধরনের লকডাউন দিলে নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। না হলে তারা খাদ্যের জন্য বাইরে বেরিয়ে গেলে আমরা কেউ নিরাপদ থাকতে পারব না। এটা সফল হবে না, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।