ঢাকা অফিস।।
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার দুই প্রধান আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) লিয়াকত আলীসহ চট্টগ্রামে ৩০ পুলিশের বিরুদ্ধে সাতটি মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। এসব মামলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে টাকা না পেয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আলোচিত এ সাতটি মামলার দুটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত চলছে। একটি মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। বাকি চারটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ও ডিবি।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত রহস্য বের করে আনা হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান মহানগর ও জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে এসব মামলার তদন্ত পুলিশকে দেওয়ায় তদন্তে নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ গত বুধবার চট্টগ্রামের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে দুই ভাইকে তুলে নিয়ে হত্যার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের ফকিরপাড়ার আমিনুল হকের দুই পুত্র আমানুল হক ও আজাদুল হককে হত্যার অভিযোগ এনে তাদের বোন রিনাত সুলতানা শাহীন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রদীপসহ ছয় পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়। বাদী অভিযোগ করেন, গত ১৩ জুলাই আমানুল হককে এবং ১৫ জুলাই আজাদকে চন্দনাইশ থেকে তুলে নিয়ে যায় টেকনাফ থানা পুলিশ। পরে তাদের পরিবারের কাছে আট লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে দুই ভাইকে ইয়াবা ব্যবসায়ী বানিয়ে ক্রসফায়ার দেয়া হয়। মামলাটি তদন্ত করছেন জেলা পুলিশের আনোয়ারা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
তার আগে পরিদর্শক লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা আদায় এবং আরও টাকার দাবিতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগে আদালতে মামলা হয়। মামলার বাদী এস এম জসিম উদ্দিনের অভিযোগ, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৭০ লাখ টাকার মালামাল চুরির ঘটনার একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন লিয়াকত আলী। তদন্তকালে আসামিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে লিয়াকত তাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। এতে তিনি রাজি না হওয়ায় ক্রসফায়ারে দেয়ার হুমকি দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা চান। প্রাণ বাঁচাতে তিনি আড়াই লাখ টাকা দিলেও তাকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। থানায় নিয়ে দফায় দফায় নির্যাতন করে তাকে পঙ্গু বানানোর পাশাপাশি ১৩টি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত করছে নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপ-কমিশনার (উত্তর)।
ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার ওসি শেখ আবদুল্লাহসহ চারজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন ভুজপুর থানা পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হেলাল উদ্দিনের স্ত্রী শারমিন আক্তার। তিনি অভিযোগ করেন, পুলিশের কথিত একজন সোর্সের ভুল তথ্যের ভিত্তিতে তার প্রবাসী স্বামীকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে দেয় পুলিশ। অথচ ধর্ষণের ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন না। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
আট লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়ার অভিযোগে বায়েজিদ থানার ওসিসহ (তদন্ত) আট পুলিশের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। ব্যবসায়ী মো. আবদুল ওয়াহেদের করা মামলাটি সিএমপির উত্তর জোনের উপ-কমিশনারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। উপ-কমিশনার বিজয় বসাক ইনকিলাবকে বলেন, আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে আদালতের কাছে প্রতিবেদন পেশ করা হবে। নিরপেক্ষভাবে মামলার তদন্ত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পটিয়ার প্রবাসী মো. জাফরকে তুলে নিয়ে ৫০ লাখ টাকা না পেয়ে হত্যার অভিযোগে পটিয়া আদালতে চকরিয়া থানার ওসি মো. হাবিবুর রহমান ও এসআই আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ৩১ জুলাই চকরিয়ায় জাফরসহ দু’জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। সিআইডি চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ ইনকিলাবকে বলেন, আদালতের নির্দেশনায় মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
গত মঙ্গলবার রাউজান থানার সাবেক ওসি কেফায়েতুল্লাসহ চারজনের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে আদালতে মামলা হয়। রাজ গোপাল চৌধুরীর মামলাটি আমলে নিয়ে চট্টগ্রামের সিনিয়ার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে কেফায়েতুল্লার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলাটি হয়েছে। সে মামলাটিরও বিচারিক তদন্ত চলছে।
এদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগে এসব মামলার তদন্তভার পুলিশের হাতে যাওয়ায় তদন্তে নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিচার প্রার্থীরা। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা তদন্তে আইনগত কোন বাধা নেই। তবে তদন্তে সন্তুষ্ট না হলে বাদী পক্ষের আদালতে নারাজি প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আদালত র্যাব বা অন্য কোন সংস্থা অথবা বিচারিক তদন্তেরও নির্দেশ দিতে পারেন।