শিল্প মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার ১ বছর পার হলেও চালু হলোনা বন্ধ থাকা ঈশ্বরদীস্থ পাবনা সুগার মিল
———
এস এম রাজা, ঈশ্বরদী প্রতিনিধি।।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের
শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক লোকসানের দায়ে বন্ধ করে দেয়া ঈশ্বরদীস্থ পাবনা সুগার মিল নতুন করে চালুর ঘোষণা দেয়া হলেও প্রায় ১ বছর পার হয়ে গেলেও মিলটি চালু হয়নি। বিগত ৫ বছর আগে উৎপাদন বন্ধের পর পাবনা সুগার মিল পুনরায় চালুর জন্য গত বছরের (২০২৪)’র ১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় মিল বন্ধের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছিল। দ্বিতীয় ধাপে মিল চালুর সেই ঘোষণার পর ১ বছর পার হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বন্ধ অবস্থায় পড়ে থেকেই নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৮০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ, আর মিলের কাঁধে জমছে ৫৫৩ কোটি টাকার ঋণ। উৎপাদন বন্ধ থাকলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে কর্মরতদের। মিল দ্রুত চালুর দাবিতে সরব হয়ে উঠেছে মিলের কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়ায় ৬০ একর জমির ওপর ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পাবনা সুগার মিল। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শেষে পরের বছর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। কার্যক্রম সচল রাখতে বিভিন্ন ব্যাংক ও সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণের সুদ সময়ের সঙ্গে ঠেলে তুলে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৫৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অলাভজনক কার্যক্রমের কারণে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
হিসাবরক্ষণ বিভাগ জানিয়েছে, উৎপাদন বন্ধের বছরেও মিল প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টন চিনি উৎপাদন করে। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ থাকায় প্রতি বছর প্রায় ৪৫ কোটি টাকা সুদ ঋণের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতায়ও মিলকে বড় অঙ্কের ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছর: ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০২২-২৩: ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪: ২ কোটি টাকা এবং ২০২৪-২৫: ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
বর্তমানে মিলের যন্ত্রপাতি রক্ষায় ৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত আছেন, যাদের মাসিক বেতনব্যয় ৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এছাড়া প্রশাসন, হিসাব, কারখানা, ইক্ষু বিভাগ ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ মোট ২৩ জন নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ এই মিলেই স্বাভাবিক সময়ে ১,২০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এক সময়ের ব্যস্ত কারখানা এখন পরিত্যক্ত ও জরাজীর্ণ। আখবাহী ট্রাক-ট্রলি আগাছায় ঢাকা, বেশিরভাগ যানবাহন মরিচা ধরে অকেজো। গোডাউন ও টিনশেডের ছাউনি ঝুলে পড়েছে, দেয়ালে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ফাটল। বয়লার হাউজ, ক্রাশার, ডোঙ্গা, রুলার, বিয়ারিংসহ মূল উৎপাদন যন্ত্রাংশ দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এক কর্মচারী বলেন, “এখন যে মাঠে ঝোপঝাড় দেখছেন, একসময় এসব জায়গা আখবাহী গাড়ি আর মানুষের পদচারণায় ব্যস্ত থাকত। চাষিরা হাসিমুখে আখ বুঝিয়ে ফিরে যেতেন। মিল বন্ধের পর সেই দৃশ্য আর নেই।”
মিলটির অধীনে ঈশ্বরদীসহ পাবনা অঞ্চলে ৮টি আখ জোন ছিল যেখানে ৫–৫.৫ হাজার কৃষক ৬ হাজার একর জমিতে আখ চাষ করতেন। মিল বন্ধের পর অধিকাংশ কৃষক আখ চাষ থেকে সরে গেছেন। মিল চালুর ঘোষণার পরও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ শুরু না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে তাদের মধ্যে।
পাবনা সুগার মিল আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও জাতীয় স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, “চাষিদের পক্ষ থেকে শিল্প উপদেষ্টার কাছে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। ঘোষণার এক বছর পেরোলেও কাজের অগ্রগতি নেই। আমরা দ্রুত মিল চালুর দাবি জানাচ্ছি।”
মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “উৎপাদন বন্ধের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে আমাদের অফিসিয়ালি কিছু জানানো হয়নি।” তিনি জানান, তিন ধাপে দেশের চিনিকলগুলো চালুর কথা শোনা গেলেও কবে নাগাদ পাবনা সুগার মিল চালু হবে—এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা তারা পাননি।
তিনি আরও বলেন, “মিল চালুর ঘোষণা দিলেও প্রস্তুতি নিতে কমপক্ষে ২ বছর লাগবে। আখের সাপ্লাই চেইনও গড়ে তুলতে হবে। তবুও আমরা চাষিদের আখ চাষ বন্ধ না করতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। এদিকে মিল জোনের আখ চাষিরা মিল একটানা বন্ধ থাকার কারণে হতাশ হয়ে পড়েছেন। নিরাশার সুরে অনেক চাষিই আখ চাষের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রেরকঃ এস এম রাজা
ঈশ্বরদী, পাবনা।