ডিপ্রেশন: কারণ ও প্রতিকার
———–ডাঃ মোঃ হুমায়ুন কবির
কিছু ভালো লাগে না, মন ভালো নেই এমন কথাগুলো অনেক লোকের মুখে শোনা যায়। আমাদের নিত্যদিনের জীবনে নানা রকম ঘটনার চাপে পড়ে মন খারাপ হয়। শারীরিক মানসিক আর্থিক যেকোনো সমস্যায় হতে পারে। মনের এরকম অবস্থাকে বলে বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন। চাইলেই হুট করে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। তবে পরিস্থিতির সাথে সব কিছু মানিয়ে চলতে পারলে ভালো তা না হলে দীর্ঘদিন মানসিক কষ্ট ভুগতে হবে। ফলশ্রুতিতে জীবন স্থবির হয়ে যায় এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ডিপ্রেশন এমন একটি মানসিক সমস্যা যার অশুভ থাবায় মানুষের জীবন হতে পারে ক্ষতবিক্ষত। কাদের হয়? যেকোনো দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ১০-২০ ভাগ লোক ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন।পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ মেয়েরা এ রোগে ভুগে থাকেন। ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যাক্তিরা অন্যদের তুলনায় এই রোগে বেশি ভুগে থাকেন।বেকার, পরিবারে অশান্তি থাকলে, নিঃস্ব জীবনযাপনকারীরা ও নেশাগ্রস্থ ব্যক্তিরা এই রোগে ভুগে থাকেন।
কারণ: ডিপ্রেশন এর প্রকৃত কারণ অজানা থাকলেও রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানা গেছে। তা নিম্নে আলোচনা করা হল:-
জেনেটিক কারণ: এরমধ্যে জেনেটিক কারণ প্রধান।পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পরিজনের মধ্যে এই সমস্যা থাকলে এ রোগ হতে পারে।
বায়োকেমিক্যাল কারণ: মস্তিষ্কের সেরোটোনিন ও নরএড্রেনালিন এর ঘাটতি এবং অনিয়ন্ত্রিত কর্টিসোল হরমোন বৃদ্ধিকে ডিপ্রেশন সৃষ্টির রাসায়নিক ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
ব্যক্তিত্ব: উদ্বেগপ্রবণ , দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তি, অল্প কিছু কে বড় করে দেখা, নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়া এসব সমস্যা ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দেয়।
স্নেহবঞ্চিত ও অবহেলা: যেসব শিশুর মা বাবার স্নেহবঞ্চিত, পারিবারিক কোন্দলের মধ্যে বেড়ে ওঠে তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের মাত্রা বেশি থাকে।
রোগব্যাধি ও ঔষধ: কিছু স্নায়বিক ও হরমোনের রোগ এবং কিছু ঔষধ যেমন,স্টেরয়েড ও জন্মনিরোধক পিল মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে ডিপ্রেশন বাড়াতে পারে।
অন্যান্য: গর্ভঅবস্থায় ও অনেকদিন যাবত নিদ্রাহীনতাও ডিপ্রেশন বাড়াতে পারে। আবার বৈবাহিক জীবনে অসুখী, কর্মস্থলের সমস্যা, একাকীত্ব ইত্যাদি সমস্যার কারণেও ডিপ্রেশন হয়।
লক্ষণ: বিষন্ন মন, আগ্রহীনতা, আনন্দহীনতা ডিপ্রেশনের প্রধান লক্ষণ। তবে এর সঙ্গে অপরাধবোধ, নৈরাশ্যবাদ, আত্মঘাতী চিন্তা, আত্মসম্মানবোধ এর অভাব, অরুচি, অনিদ্রা, ক্লান্তি, ওজনে পরিবর্তন, কাজে ধীরগতি ইত্যাদি । মনে অশান্তি, অযথা মনঃকষ্ট , দুশ্চিন্তাবোধ ও মন খালি খালি লাগা, নেতিবাচক মনোভাব, সবকিছুতে হতাশা, নিজের কোনো ভবিষ্যত নেই এমনটি ভাবা। স্মরনশক্তির অভাব, শরীর ও মাথা ব্যথা, যৌন বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। অ্যালকোহল পান করা, মাদকে জড়িয়ে পড়া। অমনোযোগী, হজমের সমস্যা, একাকীত্ব, অতিরিক্ত রাগ প্রদর্শন। শিশুদের ক্ষেত্রে মন খারাপ থাকা, ক্রমাগত কান্না করা, স্কুলে কোন সমস্যা হলে যেতে না চাওয়া, বন্ধু বা আত্মীয় পরিজনের থেকে দূরে থাকা, মৃত্যু চিন্তা, অনিদ্রা, পড়াশোনায় অমনোযোগী, রেজাল্ট খারাপ হওয়া, ক্ষুধার ধরন বদলে যাওয়া, ওজনের পরিবর্তন ইত্যাদি।
উপরোক্ত সমস্যাগুলো যদি ২ সপ্তাহের অধিক কাল স্থায়ী হয় তবে তাকে মেজর ডিপ্রেশন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।এদের মধ্যে যদি স্বল্পসংখ্যক লক্ষণ উপস্থিত থাকে তবে তাকে মাইনর ডিপ্রেশন ধরা হয়। এই মাইনর ডিপ্রেশন পরবর্তীতে মেজরে পরিণত হয়। ডিপ্রেশন তুলনামূলক ১৮-৪৫ বছর বয়সি ব্যক্তি ও মহিলাদের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
চিকিৎসা: ডিপ্রেশন দেখা দিলে মনোচিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকও ভালো ভূমিকা নিতে পারে। বিষন্নতার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ থাকলে তার সমাধান করতে হবে।
সাইকোথেরাপি রোগীর জীবন ও রোগ সম্বন্ধে নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা দূর করতে হবে।ডিপ্রেশন বিরোধী ঔষধ নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করা যেতে পারে।
করণীয়: মনে রাখতে হবে, জীবনে চড়াই-উৎরাই থাকবেই। এগুলো জীবনেরই একটি অংশ। তাই ডিপ্রেশন থেকে কাটিয়ে উঠতে হবে। মনে শক্তি ধারণ করতে হবে। রোগীর পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের রোগীর প্রতি সহমর্মী হতে হবে। রোগীকে উপহাস বা অবহেলা করা যাবে না। ডিপ্রেশনের কোন লক্ষণ দেখা দিলে তাকে মানবিকভাবে বোঝাতে হবে। তার প্রতি মানবিক ভাব প্রকাশ করতে হবে। জীবনকে ভালবাসতে হবে। জীবনের সব পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে চলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। সর্বদা পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, হাসি, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন, বেড়ানো ইত্যাদি ডিপ্রেশনের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা, পরিবারে সময় দেয়া, ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়া, সংস্কৃতির চর্চা ইত্যাদি ডিপ্রেশনকে দূরে রাখতে পারে।